Logo
×

Follow Us

জলবায়ু পরিবর্তন

প্রাণিজগতে মানবিকতার ব্যাপ্তি জরুরি

Icon

আসিফ

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৯

প্রাণিজগতে মানবিকতার ব্যাপ্তি জরুরি

মৃত তিমি মাছ। ছবি: সংগৃহীত

তিমির পূর্বপুরুষরা সেই ডেভোনিয়ান যুগে মাটিতে উঠে এলেও পরবর্তী সময়ে তারা আবার ফিরে গিয়েছিল পানিতে। বেশির ভাগ ডাঙ্গার প্রাণী যখন বিবর্তনের পথ বেয়ে মাটির বুকে অভিযোজিত হয়েছে তখন তিমির পূর্বপুরুষরা তাদের বহুদিন আগে ছেড়ে আসা আবাসস্থল হিসেবে সেই গভীর সমুদ্রকেই আবার বেছে নেয়, বিবর্তনের মহাযাত্রায় যেন উল্টো পথের যাত্রী তারা। হ্যাঁ, তাদের পূর্বপুরুষরা ছিল স্তন্যপায়ী প্রাণী; কিন্তু প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে জলহস্তীর মতো ডাঙ্গার এক স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত হয়ে সমুদ্রের গভীরে জায়গা করে নেয় এই স্তন্যপায়ীরা, প্রায় দেড় কোটি বছর ধরে।

উল্লেখ্য, মাছের শ্বাস নেওয়ার জন্য ফুলকা থাকে, কিন্তু তিমিরা শ্বাস নেওয়ার জন্য ফুসফুস ব্যবহার করে। আমাদের নবম ও দশম শ্রেণির জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্য বইয়েও অবশ্য স্তন্যপায়ী তিমিকে তিমি মাছ বলে অভিহিত করেছে।

কক্সবাজার থেকে টেকনাফের দিকে চলে যাওয়া মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে অবস্থিত হিমছড়ি সৈকত। এক পাশে খাড়া উঁচু পাহাড়, আরেক পাশে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। এই সৈকতটা একটু নির্জন, কেমন যেন প্রাচীন পৃথিবীর অনুভূতি ঘিরে ধরে। এই সৈকতে ভেসে আসা দুটো তিমিরই ওজন আনুমানিক ১০ টন। প্রথমটি লম্বায় ছিল ৪৪ ফুট ও প্রস্থে ১৬ ফুট। দ্বিতীয়টি লম্বায় ৪৬ ফুট ও প্রস্থে ১৮ ফুট। তার মানে প্রায় কাছাকাছি আকৃতির তিমি এ অঞ্চলে ভেসে আসে।

এ ধরনের তিমি আমাদের বঙ্গোপসাগরে রয়েছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এসব তিমি চোখে পড়ে। এক সামুদ্রিক প্রাণ বিশেষজ্ঞ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের জলসীমায় এত বিশালাকার তিমির সচরাচর দেখা মেলে না; গভীর সাগরে বড় জাহাজের ধাক্কায় অথবা শিকারিদের হত্যার কারণে তিমিটির মৃত্যু হতে পারে। অবশ্য পরিবেশবাদীদের ধারণা, বাংলাদেশের জলসীমার বাইরে তিমিটি মারা যেতে পারে; গভীর সাগরে মাছ ধরার জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগেও তিমিটি মারা যেতে পারে। পেটে আঘাতের চিহ্নও রয়েছে। কেউ বলেছেন এটি নীল তিমি, কেউ বলেছেন ব্রাইড’স তিমি। তবে একজন বলেছেন, ‘হিমছড়ি সৈকতে ভেসে আসা তিমিটি হ্যাম্পবাক তিমি অর্থাৎ কুঁজো তিমি। এটি মহাসাগরীয় প্রাণী। তার থেকে আরো জানা যায়, এ জাতীয় তিমি দলছুট হয়ে পড়লে মান-অভিমান বা হতাশায় অনেক সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। 

সব কথা একত্র করলে এটা বলা যায়, এই তিমিগুলো ব্যালিনপেটরা গোত্রের; এদের আটটি প্রজাতি রয়েছে। যেমন- নীল তিমি, ফিনব্যাক তিমি, হাম্পব্যাক তিমি ও ব্রাইড’স তিমি। শান্ত প্রকৃতির এই তিমিরা তাদের বাচ্চাদের স্তন্য পান করায়, লালন-পালন করে। তাদের আছে দীর্ঘ শৈশবকাল, যে সময়ের মধ্যে পূর্ণবয়স্করা তরুণদের শিক্ষা দেয়। খেলাধুলা তাদের সাধারণ অবসর-বিনোদন। এগুলো স্তন্যপায়ীদের স্বাভাবিক ধর্ম এবং বুদ্ধিমান প্রাণীদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। সাগর হলো ঝাপসা, প্রায় অন্ধকার একটা জায়গা। স্থলে প্রাণীদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি ও ঘ্রাণশক্তি যত ভালোভাবে কাজ করে, মহাসাগরের গভীরে তত ভালোভাবে কাজ করবে না। তিমিদের ওই পূর্বপুরুষরা যারা ওই ধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর ভরসা করে তাদের বাচ্চা, সঙ্গী অথবা শত্রুর অবস্থান খুঁজে বের করত, তারা খুব বেশি বংশধর রেখে যেত না। সুতরাং বিবর্তনের মাধ্যমে অন্য একটি পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছিল। তিমিদের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এটাই কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা : শব্দ ইন্দ্রিয়ের।

জীববিজ্ঞানী রজার পাইন গভীর সাগরের শব্দপথ হিসাব করে দেখেছেন যে, দুটো তিমি পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থান করেও পরস্পরের সঙ্গে ২০ হার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করতে পারে, কথা বলতে পারে। তিমিদের ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় ধরে তারা হয়তো প্রতিষ্ঠা করে থাকতে পারে এ ধরনের বিশ্বজনীন যোগাযোগের জাল। পরস্পর থেকে তারা ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে থাকলেও অতল গভীরতার মধ্য দিয়ে ভালোবাসার গানে পরিপূর্ণ কণ্ঠস্বর তারা পাঠাতে পারে। বিশালদেহী, বুদ্ধিমান ও যোগাযোগের ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রাণী প্রায় এক কোটি বছর ধরে কোনো প্রাকৃতিক শত্রু ছাড়াই বিকশিত হয়েছিল। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাষ্পচালিত জাহাজের উন্নতির ফলে সাগরের পানিতে যুক্ত হয়েছিল অশুভ শব্দদূষণ এবং নানা রকম বাধা। হাম্পব্যাক তিমিও এক ধরনের তিমি। তারা যে শব্দ করে তাকে বলা হয় গান; কিন্তু আমরা এখনো এ গানের সত্যিকারের প্রকৃতি ও অর্থ জানি না। একটি সাধারণ তিমির গান সাধারণত ১৫ মিনিট ধরে চলে আর দীর্ঘ হলে প্রায় এক ঘণ্টার মতো হয়। গড়ে হাম্পব্যাক তিমি ৫০ টন ওজন এবং ৪১ থেকে ৫০ ফুট লম্বা। এদের শব্দের তীব্রতার মান ১৭০ ডেসিবল, যা জেট বিমানের গর্জনের চেয়েও বেশি। অতএব ভেসে আসা তিমিগুলো হাম্পব্যাকও হতে পারে। 

১৯৭০ সালে রজার পাইন ও তার স্ত্রী কেটি পাইন বারমুডা থেকে তিমির কিছু গান রেকর্ড করার প্রচেষ্টায় যুক্ত হন। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারির ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় শব্দ বা সাউন্ড শিটের মাধ্যমে এগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি তাদের সদস্যদের সঙ্গে এই উল্লেখযোগ্য গানগুলোকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রায় দেড় কোটি কপি শব্দ শিটের অর্ডার দিয়েছিল। তাদের বৌদ্ধিক অবস্থানের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।

১৯৭৭ সালে ভয়েজার ১ ও ২ মহাকাশযান ১৯৯০ সালের দিকে সৌরজগৎ ছাড়িয়ে নক্ষত্রের পথে চলে গেছে। সেখানে মানুষের ৫৫টি ভাষাসহ হাম্পব্যাক তিমির সম্ভাষণসূচক শব্দ যুক্ত গোল্ডেন রেকর্ড রয়েছে। পৃথিবীর শব্দ (The sounds of Earth) শিরোনামে ঘণ্টার রেকর্ডের একটি অংশে আছে জাতিসংঘের ৬০টি সদস্য দেশের সম্ভাষণ-সূচক শব্দ ৫৫টি ভাষায়। বার্তাগুলোর মধ্যে দীর্ঘতর ছিল হাম্পব্যাক তিমির সম্ভাষণ-সূচক শব্দ, যা রেকর্ড করেছিলেন বারমুডা থেকে ১৯৭০ সালে রজার পাইন ও তার স্ত্রী কেটি পাইন। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যদি বহির্জাগতিক সভ্যতা মহাজগতে এই মহাকাশযান খুঁজে পায়, তাহলে তারা গোল্ডেন রেকর্ডটি থেকে বুঝতে পারবে মানুষ ছাড়াও বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীতে রয়েছে, তাদের মস্তিষ্ক মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বড় এবং সহাবস্থান করছে। কার্ল সাগানের ভাষায়Ñউপযোগী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভাবে তারা প্রাযুক্তিক সভ্যতা গড়ে তুলতে পারেনি, কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের হয়তো রয়েছে গভীর উপলব্ধি, অনুভূতি।

অথচ এই তিমিকে আমরা হত্যা করে লিপস্টিকের মতো অনেক ধরনের প্রসাধনদ্রব্য বানাই। ১৯৪০ সালের তিমি শিকারি একটি জাহাজের চিকিৎসক ডা. হ্যারি লিলির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকৃতিবিদ ডেভিড অ্যাটেন বোরোহ জানিয়েছেন, ‘যদি আমরা এমন একটি দৃশ্য মেনে নিতে পারি যে, পাকস্থলীতে দুই বা তিনটি বিস্ফোরক হুকবিদ্ধ অবস্থায় একটি ঘোড়াকে লন্ডনের রাস্তায় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। তবে একমাত্র এ রকম একটি দৃশ্যের সঙ্গেই তিমি হত্যার প্রক্রিয়াটিকে তুলনা করা চলে।’

আজকে পৃথিবীতে সহনশীলতা নমনীয়তার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার অজ্ঞতা ও লোভ। তিমিদের সঙ্গে সহনশীল অভিজ্ঞতাই আমাদের শেখাতে পারে শুধু দুই জাতির মানুষ নয়, প্রজাতি নয়, দুটি সম্পূর্ণ আলাদা গোত্রের বুদ্ধিমান প্রাণীও একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।

আমরা জানি না, তিমিগুলো কী কারণে মারা গেছে, পরিবেশদূষণে, মানুষের শিকারে নাকি জাহাজের আঘাতে? তবে প্রতিটি প্রাণীই ইকোলজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শুধু মানুষের জন্য নয়, অস্তিত্ব রক্ষায় তিমি ও অন্যান্য প্রাণের সঙ্গে মানবিক আচরণ জরুরি। এই বাস্তবতাই যেন উঠে আসছে বারবার।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা, সম্পাদক, মহাবৃত্ত

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫